মারি কুরি'র মেয়ে ইভ কুরি'র লেখা এই অসামান্য জীবনীগ্রন্থটা পড়ার আগে আমিও নিশ্চয়ই এইসব মামুলি উত্তর দিতাম। কিন্তু বইটা পড়ার পরে আমি বিলকুল হতভম্ব হয়ে গেছি। পরাধীন পোল্যান্ডে জন্ম নেওয়া এই নারী, সেই সময় যাঁর নিজের দেশের কোনো ইউনিভার্সিটিতে মেয়েদের অ্যাডমিশন দেওয়া নিষিদ্ধ ছিলো ; পয়সার অভাবে যাঁকে লোকের বাড়িতে গভর্নেসের কাজ করতে হয়েছে দীর্ঘদিন ; প্যারিসের প্রচণ্ড শীতে যাঁর পরিধানের জন্যে না ছিলো ঠিকঠাক শীতবস্ত্র, খাওয়ার জন্যে না ছিলো যথেষ্ট খাদ্য, বসবাসের জন্যে না ছিলো একটা ভদ্রস্থ ঘর ; তবুও যখন বইয়ের শেষের দিকে জানতে পারি : "মাদাম কুরি, বৈজ্ঞানিক, ফ্রান্স"— এইটুকু ঠিকানা লিখে পাঠালেই তাঁর কাছে চিঠি পৌঁছে যেত, তখন মনে হয়, একটা কিংবা দুটো কিংবা তিনটে কিংবা চারটে কিংবা দশটা কিংবা কুড়িটা পয়েন্টের একটা লম্বাচওড়া লিস্ট বানিয়ে মারি কুরি'র সম্পূর্ণ পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়।
এত বিচিত্র, বহুমুখী এবং অকল্পনীয় পথে তাঁর চরিত্র এবং জীবন ধাবিত হয়েছিল যে, এই রিভিউটা লিখতে বসে আমি কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখবো, কীভাবে অল্প কয়েকটা কথায় এই মানবীর পরিচয় দেবো বুঝতে পারছি না। Superwoman.
শুধুমাত্র এই একটা শব্দ লিখেই তাঁর পরিচয় দেবার কাজটা সেরে ফেলা যেত, কিন্তু তিনি তো মোটেও Superwoman ছিলেন না। তাঁর মধ্যে আদপেই তো কোনো সুপারপাওয়ার ছিলো না। কর্তব্যের প্রতি অপরিসীম নিষ্ঠা, কাজ করার প্রচণ্ড স্পৃহা, অদম্য জেদ, অদম্য আত্মসম্মানবোধ— এই গুণগুলোকে তো আর "সুপারপাওয়ার" বলা যায়না, তাইনা? যদি বলা হয়, সাধারণ মানুষের চেয়ে তাঁর বুদ্ধি এবং প্রতিভা ছিলো অনেক বেশি, এই কারণেই তিনি এরকম অবিশ্বাস্য সাফল্য অর্জন করেছিলেন, তাহলে যুক্তিটা অনেকটা সেরকম হবে, যদি মাউন্ট এভারেস্টের শিখরে ওঠার পরে কাউকে বলা হয় : ওহ, আপনার তো দুটো পা আছে, সেই কারণেই আপনি শিখরে উঠতে পারলেন!
আমি বোঝাতে পারছি কিনা জানিনা, "বিশেষ" কোনো মহাজাগতিক গুণের অধিকারী ছিলেন না মারি কুরি, তবুও তিনি বিজ্ঞানজগতের শিখরে উঠতে পেরেছিলেন, এই বিষয়টা বুঝতে পেরেই আমার এই হতভম্ব অবস্থা। তাহলে ম্যাজিকটা লুকিয়ে আছে কোথায়?
কিছু তো একটা ব্যাপার আছে যে-কারণে তিনি একজন অসামান্য মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। আচ্ছা বেশ, কারণগুলো আরেকবার বলি তাহলে? কর্তব্যের প্রতি অপরিসীম নিষ্ঠা, কাজ করার প্রচণ্ড স্পৃহা, অদম্য জেদ, অদম্য আত্মসম্মানবোধ। সত্যি বলছি, তাঁর জীবনী পড়ে অনেক খুঁজেও, অনেক ভেবেও, আমি অন্য কোনও স্পেশাল কারণ আবিষ্কার করতে পারিনি!
আমার মধ্যে যা আছে, আমার মাথায় যতটুকু বুদ্ধি আছে, যতটুকু সুযোগ আমি পেয়েছি, কেবল এইগুলো কাজে লাগিয়েই আমি অনেক কিছু করতে পারি। দরকার নেই প্রচণ্ড বুদ্ধিমান হওয়ার। দরকার নেই প্রভূত সুযোগ পাওয়ার। এই উপলব্ধিটাই মারি কুরি'র জীবন থেকে আমার সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। এই কারণেই তিনি শুধু বিংশ শতাব্দীর নয়, গোটা ইতিহাসের সবচেয়ে আইকনিক নারীদের মধ্যে...
না না, ভুল বললাম! জীবনে কখনও, কোনোদিন, নারী হওয়ার জন্যে আফসোস কিংবা উদযাপন করেননি তিনি, তাই তাঁকে শুধু "আইকনিক নারী" বললে তাঁর জীবনদর্শনের ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হবে। তিনি ছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ আইকনিক মানুষদের মধ্যে একজন।
নারী-পুরুষের ভেদাভেদ ঘুচিয়ে দেওয়ার সবচেয়ে বড় অস্ত্রটার সন্ধানও দিয়েছেন তিনি। মারি কুরি'র সেই অস্ত্রটা তাঁর জীবনের মতোই সাদামাটা, গ্ল্যামারহীন, কিন্তু কার্যকরী। অস্ত্রটার নাম : কাজ (তাঁর ক্ষেত্রে গবেষণার কাজ)। তাঁর যোগ্য সহকর্মী এবং জীবনসঙ্গী, অকালপ্রয়াত পিয়ের কুরি'র একটা কথা তিনি আজীবন মনে রেখেছেন : "যদি প্রাণটাও চলে যাওয়ার উপক্রম হয়, তবুও কাজ বন্ধ করা যাবে না।" শুধু পুরুষতন্ত্র নয়, সামাজিক বাধাবিপত্তি কিংবা অনিবার্য দুর্ভাগ্যের বিরুদ্ধেও মারি কুরি শুধু একটাই অস্ত্র প্রয়োগ করেছেন। কাজ করে যাওয়া। কাজ করে যাওয়া। আর কাজ করে যাওয়া।
আরো একটা অসাধারণ চারিত্রিক গুণ ছিলো তাঁর, যেটার কথা আলাদা করে বলা দরকার। আমি বরং বই থেকে একটা ঘটনার কথা হুবহু লিখে দিই, তাহলে ভালো বোঝা যাবে। রেডিয়াম একটি মহামূল্যবান মৌলপদার্থ। ১৯২০ সালে এক গ্রাম রেডিয়ামের দাম ছিলো এক লক্ষ ডলার। একজন আমেরিকান সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন :
- আপনার কাছে কতোটুকু রেডিয়াম আছে?
- আমার ল্যাবরেটরিতে এক গ্রামের বেশি নেই।
- আপনার কাছে মাত্র এক গ্রাম আছে?
- আমার?
ওঃ, আমার তো কিছু নেই। আমার ল্যাবরেটরির জিনিস ওটা।
- আমি স্বত্বাধিকার অনুযায়ী প্রাপ্য অর্থের কথা বললাম। আপনি তো প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারতেন।
শান্ত স্বরে তিনি জবাব দিলেন : কারুর ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করা রেডিয়ামের কাজ নয়। রেডিয়াম একটা মৌলিক পদার্থ মাত্র। তার উপর সবার সমান অধিকার।
আরো আগে, আরো অনেক আগে এই বইটা পড়লে হয়তো আরেকটু অন্যরকম হতো জীবনটা!
Copyright ©blueboy.aebest.edu.pl 2025